
প্রকাশিত: Wed, Dec 7, 2022 9:20 PM আপডেট: Wed, Apr 30, 2025 1:09 AM
বইখানি কেন অনন্ত যৌবনা?
কাজী জহিরুল ইসলাম : একটি গল্প দিয়েই শুরু করি। ২০০০ সালের এপ্রিল মাস। জাতিগত সংঘাতে রক্তাক্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত, এক জনপদ কসোভো। জাতিসংঘের ডাকে পা বাড়াই সেই রক্তাক্ত প্রান্তরের দিকে। হাতে নীল পতাকা, বুকে দৃঢ় প্রত্যয়। মেসিডোনিয়ার পর্যটন শহর অখরিডের নয়ানাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হেসে-খেলে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষ করি। এরপর আসে সেই তীর্থযাত্রার কাল। এক সকালে একটি বিশাল বাসে চড়ে আমরা যাত্রা করি কসোভোর আঞ্চলিক সদর দফতর জিল্যানের উদ্দেশে। অখরিডে, জিল্যানে দফায় দফায় মিটিং-ব্রিফিং। এসব মিটিং-ব্রিফিংয়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই থাকে নিরাপত্তা নির্দেশিকা। এখানে যাবে না, ওখানে পা রাখবে না, স্থানীয়দের সাথে মিশবে না, কার্ফিউ চলাকালীন সময়ে বাইরে যাবে না। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলেও পিচঢালা রাস্তার বাইরে এক পা-ও ফেলবে না। যেকোনো মুহূর্তে মাইন বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
আমার পোস্টিং হলো ভিটিনা মিউনিসিপ্যালিটিতে। ভিটিনা ছিল অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ মিউনিসিপালিটি। জানি না কর্তৃপক্ষ কেন আমাকে এতোটা ঝুকিপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দিল। ভিটিনা ২২ মাইলের পথ। আমাকে নিয়ে যাবে দুই শ্বেতাঙ্গীনি, একজন ব্রিটিশ তরুণী ফেনেলা ফ্রস্ট, অন্যজন সুইডিশ দীর্ঘাঙ্গী নারী মিকেলা। যেতে যেতে ওদের জিজ্ঞেস করি, দুমাস আগে একজন বাঙালি অফিসার এসেছেন ভিটিনায়, নাম জাহিদ হায়দার, তোমরা কি চেনো তাকে? ওরা দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মিকেলা একটু ইন্ট্রোভার্ট, ফেলেনা স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে একবার পেছনের সিটে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে নিলো। এরপর খুব দ্রুত প্রশ্ন করলো, তুমি কি জাহিদকে আগে থেকেই চিনতে? আমি বলি, হ্যাঁ, হি ইজ অ্যা পোয়েট। আমিও কবিতা লিখি, সেই সুবাদে আমাদের সখ্যতা আছে।
আমার এই কথায় দুই উদ্ভিন্ন যৌবনা ইউরোপীয় নারী কিছুটা আহত হলো। আমি বুঝলাম, ওরা জাহিদকে পছন্দ করেন না। পছন্দ না করার কারণ আমি কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম। জাহিদ হায়দার প্রায় প্রতিটা মিটিংয়েই ওদের উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করে। সুযোগ পেলেই ওদের-সহ ইউরোপীয়দের ভুল ধরে এবং যেকোনো অজুহাতে ওদের জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক কারণেই জাহিদ হায়দারের সান্নিধ্য আমার বেশি ভালো লাগত। কাজের বাইরে কিংবা কাজের ভেতরেও সময় পেলেই আমরা দেখা করতাম, বাংলা কবিতা নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুলতাম। দুজন দুজনের কবিতা পড়তাম। জাহিদ হায়দার ছিলেন ভিটিনা মিউনিসিপালিটির রেকর্ড অফিসার। তিনি আইটিতে ততোটা দক্ষ ছিলেন না। ঘটনাচক্রে আমি নিজেও ততোটা দক্ষ না হলেও প্রচার হয়ে গেলো যে আমি একজন আইটি বিশেষজ্ঞ।
একদিন দুপুরে জাহিদের অফিসে, ওর কম্পিউটার সেট-আপটি ঢেলে সাজাতে সাহায্য করছিলাম। দেয়ালের পাওয়ার প্লাগ-পয়েন্টটি ছিল বেশ উঁচুতে। জাহিদ হায়দার খাটো মানুষ, সেটি নাগাল পাচ্ছিলেন না, আমিও নাগাল পাচ্ছিলাম না। এতো উঁচুতে পাওয়ার পয়েন্ট কোন আক্কেলে আলবেনিয়ানরা বানালো কে জানে। আমি উঁচু হওয়ার জন্য পাশের বুকশেলফ থেকে বেশ কিছু মোটা বই তুলে এনে ফ্লোরে রাখলাম। বইগুলোর ওপর পা রেখে প্লাগটি পাওয়ার পয়েন্টে ঢোকালাম। জাহিদ হায়দার এই দৃশ্য দেখে আমার দিকে কিছুক্ষণ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি বলি, কিছু বলবেন? তিনি বলেন, পারফেক্ট মডার্ন ম্যান। বাঙালিরা যতোটা বই পড়ে তার চেয়ে হাজার গুন বেশি বই-পুস্তকের পুজো করে। আমি এই প্রথম কোনো বাঙালিকে দেখলাম বইয়ের ওপর জুতোসহ দাঁড়িয়ে কাজ করছে। ব্রাভো। এরপর দুজনেই হাসলাম। মনে মনে কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম, তিনি আবার আমাকে গর্দভ ভাবছেন না তো।
আজকের লেখার মূল বিষয় এটিই। আমি প্রায়শই দেখি আমার অনেক বন্ধু, চেনা-পরিচিত জন, বই প্রসঙ্গে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তারা শঙ্কা অনুভব করেন তাদের মৃত্যুর পরে এই অমূল্য গ্রন্থগুলোর কী হবে? বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকেন তারা এই চিন্তাটা বেশি করেন। উত্তর প্রজন্মের কেউ তো আর বাংলা পড়ে না, ওরা কি বাংলা বইগুলোর যত্ন করবে? সৈয়দ মুজতবা আলী বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলা হয়ে আসবে কিন্তু এই বইখানা অনন্ত যৌবনা’। বই প্রসঙ্গে কথা উঠলে আমরা প্রায়শই মুজতবা আলীর এই কথাটি কোট করি। কিন্তু আমরা ভালো করে এর গূঢ়ার্থটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না। বইখানি কেন অনন্ত যৌবনা? বই কি বউ যে সেজেগুজে আমার সামনে এসে বসবে আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার রূপ দর্শন করব? বইয়ের যৌবন হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত জ্ঞানে।
এর মধ্যে যে জ্ঞান আছে যদি তা আহরণ করতে না পারি, যদি তা পাঠ না করি, তাহলে দর্শনের একটি বিখ্যাত বই আর উঠতি লেখকের ভুলে ভরা পাঠ-অযোগ্য কোনো বইয়ের মধ্যে তফাৎ কী? উত্তর প্রজন্মের কাছে বইগুলো হস্তান্তরের চেয়ে বড়ো কাজ হলো বই থেকে অর্জিত জ্ঞান উত্তর প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা। যদি জ্ঞান হস্তান্তর করতে পারি তাহলে আর আমাদের কোনো আক্ষেপ বা ভয় থাকবে না তা মিসপ্লেসড হবার, হারিয়ে যাবার, ছিঁড়ে-মুছে যাবার। যারা উন্নত দেশে বসবাস করেন তারা একটু লক্ষ করলেই দেখবেন একটি বই পড়া শেষ হয়ে গেলে ওরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্বেজ বিনে ফেলে দিচ্ছে। আমি আগুন জ্বালাতে খুব পছন্দ করি। বাড়ির পেছনে একটি ফায়ার পিট আছে, ওখানে প্রায়শই আগুন জ্বালাই। যে বইগুলো পড়া হয়ে যায় কিংবা অপাঠ্য মনে করি, অথবা পুনরায় আর পড়ার দরকার হবে না, সেগুলো কেউ নিতে চাইলে দিয়ে দিই, নয় তো ফায়ার পিটে ফেলে পুড়িয়ে ফেলি। একদিন আমার এক বন্ধু বেড়াতে এসে ফায়ার পিটে অর্ধপোড়ানো কিছু বই দেখে আঁতকে ওঠেন, জিভে কামড় দেন। কী আশ্চর্য তুমি একজন কবি হয়ে বই পুড়িয়ে ফেলছ। বই তো মূলত একদলা কাগজ ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা ফেলে দিলে, হারিয়ে গেলে, পুড়িয়ে ফেললে কোনো ক্ষতি নেই কিন্তু বইয়ের ভেতরে যে জ্ঞান লুকোনো আছে তা আহরণ করতে হবে, যতোটা পারা যায়। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
